রবিবার, ১০ নভেম্বর ২০২৪, ১১:২৬ অপরাহ্ন
এ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিকঃ
প্রায় ২২ লক্ষ জনসংখ্যা অধ্যুষিত সাংস্কৃতিক রাজধানী কুষ্টিয়া। এ জেলার প্রশাসক আসলাম হোসেনের যোগদান থেকেই স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা নিয়ে নানা রকম গুঞ্জন চলে আসছে। সম্প্রতি ডিসি অফিসে নিয়োগ বানিজ্য নিয়ে নানারকম মুখরোচক খবর চাউর হয়ে উঠেছে। শুধু এ জেলাতেই নয়, পত্রপত্রিকা ও ইলেকট্রনিক্স মিডিয়ার মাধ্যমে পুরো দেশবাসীর মাঝে খবরটি পৌঁছে গেছে। চাকরি নাকি হয়েছে জেলা প্রশাসকের বাসার বাবুর্চির ছোট বোন আর অবৈধ বালুরঘাট থেকে ডিসির হয়ে টাকা আদায়কারী দু’জনসহ অন্য স্টাফদের ভাই-বোনের। বাইরের যাদের চাকুরি হয়েছে তাদের নাকি গুনতে হয়েছে মোটা অংকের উৎকোচ। আবার বয়স ও সনদ জালিয়াতি করে চাকুরি নিলেও তাতে কার কি যায় আসে। এতক্ষণ যে কথাগুলো লিখছিলাম তার সবই বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত খবর থেকে সংগৃহিত।
আর কতোকাল সকল অন্যায়-অবিচার মাথা পেতে সহ্য করবেন! প্রমান করার সময় এসেছে, আপনার বিবেক এখোনো পুরোপুরি ক্ষয়ে যায় নি! আওয়াজ তুলুন আরেকবার, যেমনটি আওয়াজ তুলেছিল বীরাঙ্গনা নাঙ্গেলী। এবার সেই গল্পটি দিয়েই শুরু করি।
২১৫ বছর আগে ভারতের কেরালা’র রাজা ছিলেন ত্রিভাঙ্কুর। তার আমলে নাকি পুরুষরা গোঁফ রাখতে চাইলেও কর দিতে হতো। আর নারীদের দিতে হতো স্তনকর। আইনটি ছিল এরকম যে, ব্রাহ্মণ ব্যতীত হিন্দুধর্মের অন্য কোন নারী তার স্তন আবৃত রাখতে পারবে না! নারীদের স্তন রাখতে হবে অনাবৃত, উন্মুক্ত! আবৃত করতে হলে বা স্তন ঢেকে রাখতে চাইলে দিতে হবে স্তনশুল্ক! আবার এই শুল্কের পরিমাণ নির্ভর করবে স্তনের আকারের উপর! যার স্তন যতবড় তার শুল্ক ততো বেশী! এই স্তনশুল্কের মোটা অংশ চলে যেত পদ্মনাভ মন্দিরে! গিনেস বুকের তথ্য অনুযায়ী, এটি পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী মন্দির! এবার শুনুন আসল গল্প। ৩৫ বছর বয়সী কৃষ্ণ বর্ণের অতীব সুন্দরী এক নারীকে প্রায়ই কাজের জন্য বাইরে যেতে হতো! তবে সে সবসময় তার স্তন ঢেকে রাখতো! হঠাৎ একদিন সে শুল্ক সংগ্রাহকের নজরে পড়লো, শুল্ক সংগ্রাহকরা তার কাছে স্তনশুল্ক দাবী করলো! অস্বীকৃতী জানিয়ে মেয়েটি বললো, স্তন আমার, তাকে আবৃত রাখব, নাকি অনাবৃত রাখব তা ঠিক করার তুমি কে! আমি শুল্ক দেবো না! কিন্তু তাতে লাভ হলো না। প্রতিদিন শুল্ক সংগ্রাহকরা তার বাড়িতে এসে তাকে শুল্ক দেওয়ার জন্য চাপ দিতে লাগলো! দিনে দিনে করের বোঝাও বাড়তে থাকে!
অবশেষে একদিন কর দিতে রাজী হলো মেয়েটি! শুল্ক সংগ্রাহকদের বাইরে অপেক্ষা করতে বলে দরজা বন্ধ করে ঘরের ভিতরে চলে যায় সে, তারপর ধারালো অস্ত্র দিয়ে কেটে ফেলে তার স্তন দুটি! নিজের স্তনদ্বয়কে কলাপাতার আবরণে মুড়িয়ে শুল্ক সংগ্রাহকের হাতে শুল্কস্বরূপ তুলে দেয় তার রক্ত মাখা স্তন! তারপর বলে, যে জিনিসের জন্য আমাকে অতিরিক্ত শুল্ক গুনতে হয়, সেই জিনিসই আমি রাখবো না। বিস্বয়ে হতবাক হয়ে যায় শুল্ক সংগ্রাহকসহ পাড়া প্রতিবেশী সবাই! অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে মেয়েটির মৃত্যু হয়। পুরো ভারতে ছড়িয়ে পড়ে এই ঘটনা। কয়েকদিন পর রাজা ত্রিভাঙ্কুর স্তনশুল্কসহ সকল প্রকার অবৈধ শুল্ক বাতিল করতে বাধ্য হন! নিজের অজান্তেই মেয়েটি ১৮৫৯ সালে ভারতে সংগঠিত কাপড় দাঙ্গা’র বীজ বপন করে যায়। নিজেকে কতটা ভালবাসলে এমনটা করা যায় ভাবতে পারেন? এই আত্মপ্রেমী নারীর নাম নাঙেলি!
মানুষ নিজেকে সবচেয়ে বেশী ভালোবাসে অথচ নিজের আত্মত্যাগের বিনিময়ে পুরো কেরালার নারীদের আব্রুরক্ষা করেছিলো বীরাঙ্গনা নাঙ্গেলি। পাঠক! সেও পারতো বাকী সব নারীদের মতো স্তনশুল্ক মেনে নিতে। শুল্ক দেওয়ার মতো সক্ষমতাও তার ছিলো। কিন্তু পৃথিবীতে কেউ কেউ বুকে আগুন নিয়ে জন্মায়। কোনো অন্যায় তাদের সামনে আসলেও তা তাদের বুকে স্থান পায় না, বুকের আগুনে ভস্মিভূত হয়ে যায় সব অন্যায়গুলো। তাইতো নিজের সুখ,শান্তি,চাওয়া-পাওয়া সর্বস্ব উজাড় করে দিয়ে নারীদেরকে অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে শিখিয়েছিলো নাঙ্গেলি।
পাঠক! কাহিনী এখনো বাকী! নাঙ্গেলির শরীর তখনও চিতায় দাউদাউ করে জ্বলছে। হঠাৎ একটা লোক দৌড়ে এসে সেই চিতার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। লোকটা নাঙ্গেলির স্বামী। ভারতের ইতিহাসে, স্ত্রীর সঙ্গে সহমরণে যাওয়া কোনো পুরুষের প্রথম এবং শেষ ঘটনা। ইতিহাস এই প্রেমিক পুরুষের নাম খোদাই করার তাগিদ অনুভব করেনি। কিন্তু যে আগুন নাঙ্গেলি জ্বালিয়ে দিয়েছিলো ভারতীয় নারীদের মনে, তা আজও জ্বলজ্বল করে। তারা অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে শিখেছে।
আজ আপনার দেশের ১০০ ভাগ চাকরি প্রার্থীর মধ্যে চাকরী তারাই পাচ্ছে যাদের মামা, খালু আছে, আর আছে ঘুষ আর দলীয় প্রভাব ইত্যাদি!
আজ আপনাকে স্তন কেটে এই অন্যায়ের প্রতিবাদ জানাতে হবে না, অন্তত এটা স্বীকার করুন যে, আপনার সাথে একটা অন্যায় হচ্ছে! বর্তমান কুষ্টিয়ার জেলা প্রশাসক আসলাম হোসেনের মতো সুবিধালোভী শাসকেরা তাদের সুবিধা ভোগ করার জন্য একটা বড় অন্যয় আপনার উপর চাপিয়ে দিচ্ছে। আপনি আপনার অবস্থান থেকে সেই অন্যায়ের প্রতিবাদ করুন! যেমনটি আমি মামলা, মোকদ্দমা হয়রানির আশংকা জেনেও এ লেখাটির মধ্যে দিয়ে জেলা প্রশাসকের ন্যাক্কারজনক নিয়োগ বানিজ্যের তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছি।
লেখকঃ বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী, আইনগ্রন্থ প্রণেতা, পিএইচ.ডি ফেলো ও সম্পাদক-প্রকাশক ‘দৈনিক ইন্টারন্যাশনাল’। ই-মেইলঃ seraj.pramanik@gmail.com, মোবাইলঃ ০১৭১৬৮৫৬৭২৮